ইদানিং একের পর এক তরুণ, শিক্ষিত ও পরিশ্রমী মাদরাসা শিক্ষক তাদের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। কেউ অনলাইন ব্যবসায় নামছেন, কেউ ছোট কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন, আবার কেউ ফ্রিল্যান্সিং বা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে কাজ শুরু করেছেন।
অনেকে ভাবেন, হয়তো তারা দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেছেন। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। বরং বাধ্যতাই তাদেরকে নতুন পথে হাঁটতে শিখিয়েছে।
১. বেতনের বাস্তবতা:
বাংলাদেশের অধিকাংশ মাদরাসায় একজন উস্তাদের মাসিক বেতন মাত্র ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা। আজকের দিনে চাল, ডাল, তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওষুধ - সবকিছুর দাম আকাশছোঁয়া। এই টাকায় একটি পরিবার চালানো মানে প্রতিদিন নতুন করে চিন্তার বোঝা কাঁধে তোলা।
অনেক মাদরাসায় আবার বেতন ২-৩ মাস পর দেয়া হয়, যার ফলে শিক্ষকরা আর্থিক চাপে পড়ে যান। অন্যদিকে অনেক মুহতামিম বা কর্তৃপক্ষ নিজেদের আরামে অভ্যস্ত - দামী গাড়ি, প্রভাবশালী সম্পর্ক - কিন্তু উস্তাদের প্রাপ্য সম্মান ও পারিশ্রমিক যেন তাদের চোখে অপ্রয়োজনীয়!
২. ছুটির সীমাবদ্ধতা ও মানবিকতার অভাব:
বেশিরভাগ মাদরাসায় ছুটির ধারণা খুবই সীমিত। প্রতি দুই সপ্তাহে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত একটিমাত্র ছোট ছুটি — তাও অনেক সময় কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।
⃣ কারও স্ত্রী অসুস্থ হলে ছুটি চাওয়া গেলেও অনুমতি মেলে না।
⃣ কেউ অসুস্থ হলে, পরিবারে সমস্যা থাকলেও “দায়িত্বের কথা বলে” ছুটি নাকচ করা হয়।
⃣ অনেক মাদরাসায় উস্তাদদের বলা হয়, মাদরাসার বাইরে বাসা নেয়া যাবে না — সর্বদা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে থাকতে হবে।
👉 এতে করে শিক্ষকরা নিজেদের পরিবার, সন্তান এমনকি সমাজের সঙ্গেও দূরে সরে যাচ্ছেন।
৩. উস্তাদদের মূল্যায়নের অভাব:
এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বেদনাদায়ক বাস্তবতা। যাদের হাত ধরে ছাত্ররা ইসলাম, কুরআন, নৈতিকতা শেখে - সেই উস্তাদরাই অনেক মাদরাসায় অবমূল্যায়নের শিকার।
অনেক সময় দেখা যায়- ছাত্র বা অভিভাবকের সামনে উস্তাদকে তুচ্ছ করা হয়। ভুল বোঝাবুঝির নামে অপমান করা হয়। এমনকি ক্ষুদ্র বিষয়ে “বদলি” বা “চাকরি হারানোর হুমকি” দেওয়া হয়। এর ফলে একজন উস্তাদ তার আত্মসম্মান হারান, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, এবং শেষে সিদ্ধান্ত নেন-“যে কাজেই হোক, অন্তত নিজের পরিবারটা একটু স্বস্তিতে রাখি।”
৪. নতুন আশার পথ: ব্যবসা ও অনলাইন উদ্যোগ:
এই সব বাস্তবতার ভেতর থেকেই জন্ম নিচ্ছে এক নতুন প্রবণতা -তরুণ উস্তাদদের ব্যবসায়িক জাগরণ। অনেকে এখন নিজস্ব অনলাইন স্টোর খুলছেন, কেউ ডিজিটাল মার্কেটিং শেখাচ্ছেন, কেউ আবার কন্টেন্ট ক্রিয়েশন বা ইউটিউবে ইসলামিক শিক্ষা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এতে যেমন তারা আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হচ্ছেন, তেমনি সম্মানের সঙ্গেও পরিবারকে সময় দিতে পারছেন।
৫. সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন:
আমাদের সমাজ এখনো মনে করে- “উস্তাদ মানে তো ত্যাগ করবে!”
কিন্তু প্রশ্ন হলো, ত্যাগের নাম করে দারিদ্র্যকে কি মহিমান্বিত করা যায়? ইসলাম তো শিক্ষা দিয়েছে, “নিজে সচ্ছল হও, যাতে অন্যের ওপর বোঝা না হও।” তাহলে একজন মাদরাসা শিক্ষক যদি ব্যবসা করে হালালভাবে পরিবার চালান, তাতে আপত্তির কী আছে?
উপসংহার:
তরুণ মাদরাসা শিক্ষকরা চাকরি ছাড়ছেন আর্থিক বিলাসের জন্য নয়, বরং বেঁচে থাকার জন্য। যদি তাদের ন্যায্য বেতন, সম্মান, এবং মানবিক পরিবেশ দেওয়া হয়, তাহলে তারা আবারও ইসলামী শিক্ষার ময়দানে ফিরে আসবেন। সমাজের উচিত এখন তাদের বিকল্প পথে হাঁটার কারণটা বোঝা, দোষ নয় - সহমর্মিতা দেখানো।
প্রায় জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ):
Q1. মাদরাসা শিক্ষকরা কেন অনলাইন ব্যবসায়ে আসছেন?
➡️ কারণ তারা আর্থিক নিরাপত্তা, সম্মান ও পারিবারিক ভারসাম্য খুঁজছেন যা অনেক মাদরাসায় অনুপস্থিত।
Q2. ব্যবসা করা কি একজন উস্তাদের জন্য ঠিক?
➡️ অবশ্যই, যদি তা হালাল পথে হয়। ইসলামও বৈধ উপার্জনকে উৎসাহ দিয়েছে।
Q3. এই প্রবণতা সমাজে কী প্রভাব ফেলছে?
➡️ ইতিবাচক দিক হলো- তারা প্রযুক্তিনির্ভর ও স্বনির্ভর হচ্ছেন। নেতিবাচক দিক হলো- ইসলামী শিক্ষাক্ষেত্রে যোগ্য উস্তাদের অভাব দেখা দিচ্ছে।
পোস্ট ট্যাগ:
মাদরাসা শিক্ষক, মাদরাসা চাকরি, তরুণ উস্তাদ, ইসলামী শিক্ষা, অনলাইন ব্যবসা, শিক্ষক বেতন, মাদরাসা সমস্যা, ইসলামিক শিক্ষা, বাংলাদেশ মাদরাসা, মাদরাসা শিক্ষক কেন চাকরি ছাড়ে, মাদরাসা শিক্ষক ব্যবসা, Madrasa teacher business Bangladesh